ফাজায়েল ও মাসায়েলে কুরবানী পর্বঃ ০২

ফাজায়েল ও মাসায়েলে কুরবানী পর্বঃ ০২

কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ

কুরবানী সম্পর্কে ইতিহাস কমবেশী সকলের জানা আছে। মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এই ইতিহাস তুলে ধরেছেন। কুরবানী মূলতঃ আমাদের জাতি পিতা ইবরাহীম আঃ এর সূন্নাত। এখানে একটি বিষয় বলে নেয়া ভালো, ইদানীং শায়েখ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ সাহেবের একটি ভিডিও ক্লিপ নিয়ে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেছেন জাতির পিতা ইবরাহীম আঃ নয় বরং আদম আঃ হচ্ছেন জাতির পিতা। কথাটা একেবারেই ঠিক নয়। আদম আঃ শুধু কোন জাতি, গোত্র বা বর্ণের পিতা নয় বরং তিনি সকল মানবের পিতা। আর ইবরাহীম আঃ হচ্ছেন মুসলিম জাতির পিতা।

মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এসম্পর্কে বলেছেন।

তোমাদের জাতির পিতা ইবরাহীম আঃ তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম।

{সূরা হাজ্জ, আয়াতঃ ৭৮}

ইবরাহীম আঃ মহান আল্লাহ তাআলার বন্ধু। তাঁকে বলা হয় ইবরাহীম খলিলুল্লাহ। তাঁকে আল্লাহ তাআলা অনেক বড় বড় পরিক্ষার সম্মুখীন করেছেন আর মহান রবের দয়ায় সকল পরিক্ষা অত্যন্ত সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

পরিক্ষা নং একঃ নমরুদের মূর্তি ভাঙ্গার অপরাধে তাঁকে বিশাল অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। মহান আল্লাহ তাআলা তাঁকে সেখান থেকে রক্ষা করেছেন।

পরিক্ষা নং দুইঃ একটি সন্তানের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আল্লাহর দরবারে কেঁদেছেন পরে বৃদ্ধ বয়সে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁকে একটি ছেলে সন্তান ইসমাঈল আঃ কে দান করেছেন।

পরিক্ষা নং তিনঃ আল্লাহ তাআলার নির্দেশে শিশু সন্তানসহ তাঁর স্ত্রী হাজেরা আঃ কে মক্কার মরুভূমিতে নির্বাসন দিয়ে এসেছেন।

পরিক্ষা নং চারঃ মহান আল্লাহ তাআলার নির্দেশে শিশু ইসমাঈল আঃ কে কুরবানী করে দিয়েছেন।

ইসমাঈল আঃ কে কুরবানী সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছে,

হে পরওয়ারদিগার! আমাকে একটি সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দাও।

(এ দোয়ার জবাবে) আমি তাঁকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।

সে পুত্র যখন তার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে পৌঁছলো তখন (একদিন ইবরাহীম তাঁকে বললো, “হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি যাবেহ করছি, এখন তুমি বল তুমি কি মনে করো?” সে বললো, “হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন।”

শেষ পর্যন্ত যখন এরা দু’জন আনুগত্যের শির নত করে দিল এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল।

এবং আমি আওয়াজ দিলাম, “হে ইবরাহীম!

তুমি স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিয়েছো। আমি সৎকর্মকারীদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি।

নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা।

একটি বড় কুরবানীর বিনিময়ে আমি এ শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিলাম

এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তার প্রশংসা রেখে দিলাম।

শান্তি বর্ষিত হোক ইবরাহীমের প্রতি।

আমি সৎকর্মকারীদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি।

{সূরা আস সাফ্ফাত, আয়াতঃ ১০০ হতে ১১০ নং পর্যন্ত}

পরবর্তীতে ইবরাহীম আঃ এর এই সূন্নাতকে সামর্থ্যবান সকল মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক করে দেয়া হল।

কুরবানীর পশুঃ


উট, গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা এইসব প্রাণী দিয়ে কুরবানী দিতে হবে।

আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিং বিশিষ্ট ও মোটাতাজা (শক্তিশালী) একটি মেষ কুরবানী করেছেন। এর চেহেরা, পা ও চোখ ছিল মিটমিটে কালো।

{তিরমিযী শরীফ, ১৪৯৬ ইবনু মা-জাহ, ৩১২৮}

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু'টি মেষ দিয়ে কুরবানী আদায় করতেন। আমিও কুরবানী আদায় করতাম দু'টি মেষ দিয়ে।

{বুখারী শরীফ, ৫০৪২}

যেসব পশু দ্বারা কুরবানী জায়েজ নেইঃ


বারা ইব্‌ন আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত,

তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে বলতে শুনছি, তখন তিনি তাঁর আঙ্গুল দ্বারা ইঙ্গিত করছিলেন। আর আমার অঙ্গুলি রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর আঙ্গুল অপেক্ষা ছোট। তিনি তাঁর আঙ্গুল দ্বারা ইঙ্গিত করে বললেনঃ কুরবানীতে জায়েয নয় কানা পশু, যার কানা হওয়া প্রকাশ্য; খোঁড়া পশু, যার খোঁড়া হওয়া প্রকাশ্য; রুগ্ন পশু, যার রোগ প্রকাশ্য; আর দুর্বল পশু, যার হাঁড়ে মজ্জা নেই।

{নাসাঈ শরীফ, ৪৩৭১}

হুজায়্যা ইব্‌ন আদী (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেনঃ আমি আলী (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে আদেশ করেছেন আমরা যেন কুরবানীর পশুর চোখ ও কান উত্তমরূপে দেখে নিই।

{নাসাঈ শরীফ, ৪৩৭৬}

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের আদেশ করেছেন, আমরা যেন কুরবানীর পশুর চোখ ও কান উত্তমরূপে দেখে নিই। আর আমরা যেন কানের অগ্রভাগ কাটা, কানের পেছন দিক কাটা লেজ কাটা এবং কানের গোড়া থেকে কাটা পশু কুরবানী না করি।

{নাসাঈ শরীফ, ৪৩৭২}

ঈদের দিন নামায আদায় করার পূর্বে কুরবানী করলে আবার কুরবানী করতে হবেঃ
জুনদুব ইবনু সুফ্‌ইয়ান বাজালী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেনঃ আমি কুরবানীর দিন নবী (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর নিকট হাজির ছিলাম। তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তি সলাত আদায়ের আগে যবহ্‌ করেছে, সে যেন এর স্থলে আবার যবহ্‌ করে। আর যে ব্যক্তি যবহ্‌ করেনি, সে যেন যবহ্‌ করে নেয়।

{বুখারী শরীফ, ৫০৫১}

কুরবানীর গোশত যতদিন ইচ্ছা জমিয়ে রাখা যাবেঃ
সালামাহ ইবনু আকওয়া' (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের যে লোক কুরবানী করেছে, সে যেন তৃতীয় দিনে এমন অবস্থায় সকাল অতিবাহিত না করে যে, তার ঘরে কুরবানীর গোশ্ত কিছু থেকে যায়। পরবর্তী বছর আসলে, সাহাবীগণ বললেনঃ হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমরা কি তেমন করব, যেমন গত বছর করেছিলাম? তখন তিনি বললেনঃ তোমরা নিজেরা খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং সঞ্চয় করে রাখ, কারণ গত বছর মানুষের মধ্যে ছিল অনটন। তাই আমি চেয়েছিলাম, তোমরা তাতে সহযোগিতা কর।

{মুসলিম, ১৯৭৪, বুখারী, ৫০৫৮}

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
No Comment
Add Comment
comment url